শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

গ্রিক পুরাণের বিশিষ্ট নারী শিকারী : আটালান্টা



আটালান্টা।  
গ্রিক পুরাণের বিশিষ্ট নারী শিকারী। আমার মনে হয়েছে গ্রিক পুরাণের অন্যান্য চরিত্রদের তুলনায় আটালান্টার জীবনকাহিনীই সব চেয়ে বিচিত্র । শিশুবয়েসে মাবাবা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে আরণ্যক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ... তারপর অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এক দানবীয় শূকর হত্যা; অতঃপর পিতামাতার সঙ্গে মিলন এবং বিবাহ ... শেষাবধি অবশ্য অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে দেবী আর্টেমিসের অভিশাপে সিংহীতে রূপান্তরিত হওয়া -এ সমস্ত মিলিয়ে আটালান্টা উপাখ্যানটি গ্রিক পুরাণে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে । গ্রিক মিথীয় জগতে দেবদেবীর ইচ্ছাই যে চূড়ান্ত -আটালান্টা উপাখ্যানটি আমাদের সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আটালান্টার অদম্য সাহস ও শক্তি যেন নারীর সহজাত শক্তির প্রতিই ইঙ্গিত করে ...




গ্রিসের মানচিত্রে আর্কেডিয়ার অবস্থান । আর্কেডিয়া গ্রিসের একটি অঞ্চল হলেও আর্কেডিয়া বলতে ইংরেজি ভাষায় বোঝায় imagined place of rural bliss: a place in which people are imagined or believed to enjoy a perfect life of rustic simplicity আর্কেডিয়া শব্দটি বাংলা ভাষায় একেবারে অপরিচিত নয়। কবি রফিক আজাদ- এর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’।

অনেক অনেক দিন আগের কথা। আর্কেডিয়া রাজ্যটি আইয়াসুস নামে একজন রাজা শাসন করতেন। রাজা আইয়াসুস-এর স্ত্রীর নাম ছিল ক্লাইমেনে। যা হোক। রাজার বড় পুত্রসন্তানের শখ ছিল। তথাপি একটি কন্যাশিশু জন্মাল। রাজাকে প্রগাঢ় হতাশা গ্রাস করে। ক্রোধান্বিত রাজা অনুচরদের নির্দেশ দিলেন: যাঃ, ওটাকে আর্কেডিয়ার অরণ্যপ্রান্তরে ফেলে আয়। ওটাকে নেকড়েরা খেয়ে ফেলুক! (রাজা আইয়াসুস এবং এবং উপকথার রচয়িতাগন পুরুষ। কাজেই তারা এমন নির্মম সিদ্ধান্ত নিতেই পারে । তবে রানী ক্লাইমেনের এতে সম্মতি ছিল কি?) ... যা হোক। দেবী আর্টেমিস দূর থেকে সবই দেখছিলেন। তিনি একটি মা-ভালুক পাঠালেন আর্কেডিয়ার অরণ্যপ্রান্তরে । তারই দুধ খেয়ে বাঁচল শিশুটি। প্রচন্ড শীতে পেল রোমশ উষ্ণতা। আর্কেডিয়ার অরণ্যপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় দক্ষ ব্যাধের দল। তাদের মাঝেই বেড়ে উঠতে লাগল শিশুকন্যাটি। তারা শিশুকন্যার নাম রাখল আটালান্টা। কিংবা নাম দেবী আর্টেমিসও রাখতে পারেন।
কুমারী আটালান্টা দেবী আর্টেমিস এর মতোই দক্ষ শিকারী হয়ে উঠল।



আটালান্টা।

আটালান্টার সৌন্দর্য ও সাহস দেখে ব্যাধেরা অবাক। দ্রুত দৌড়াতে পারে আটালান্টা। যে কাউকে হারাতে পারে লড়াইয়ে । বিখ্যাত সব বীরদেরও হারিয়েছে। এমন কী ট্রয়যুদ্ধের গ্রিকবীর আকিলিস- এর বাবা পেলাসকেও। centaurs হল গ্রিক উপকথার অশ্বমানব। দুটি অশ্বমানব আটালান্টা কে ধর্ষন করতে উদ্যত হলে তাদের হত্যা করেছিল। মেষচর্মের জন্যে গ্রিক বীর জেসন-এর অভিযানের কথা আমরা জানি । এদের সঙ্গে আটালান্টা ছিল। অবশ্য কোনও কোনও ভাষ্য মতে নারী বলে জেসন তাকে অভিযানে নেয়নি!
আজীবন কুমারী থাকবার ব্রত ছিল আটালান্টার।
এর কি কারণ?
মা ভালুকের দুগ্ধ পান করা অরণ্যচারী ব্যাতিক্রমী শৈশব?
তাহলে তো বলতেই হয় গ্রিক মিথের রচয়িতাগন মানবচরিত্র সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।



কালিদোনিয় শূকর শিকার


আটালান্টা কালিদোনিয় শূকর শিকারে অংশ নিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। কালিদোনিয় রাজা অনিউস একবার দেবী আর্টেমিস-এর উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। আর্টেমিস প্রতিশোধ নিতে কালিদোনিয়ায় বিশাল এক শূকর পাঠালেন । শূকরটি কালিদোনিয় ফসলের ক্ষেত আঙুরের ক্ষেত তছনছ করল। মানুষ প্রাণভয়ে নগরে আশ্রয় নিল। ফসলের অভাবে তারা ক্ষুধার্ত রইল। রাজা অনিউস উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রাজা অনিউস ছেলে মেলিয়াজার। রাজা মেলিয়াজার কে শূকর হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন । মেলিয়াজার বলল, আমার সঙ্গে কয়েকজন বীর শিকারী দিন। তৎকালীন সেরা শিকারীরা মেলিয়াজার এর সঙ্গে যোগ দিল। তাদের সঙ্গে আটালান্টাও ছিল। মেলিয়াজার দেখামাত্রই আটালান্টার প্রেমে পড়ে গেল। শিকার শুরু হলে আটালান্টা প্রথমেই শূকরটিকে তীর ছুড়ে আহত রক্তাক্ত করে। এতে দলের পুরুষ শিকারী যেমন বিস্মিত হল তেমনি লজ্জ্বাও পেল। যা হোক। শেষ পর্যন্ত মেলিয়াজার শূকরটিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এতে অন্যান্য পুরুষ শিকারীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। আটালান্টাই প্রথম শূকরের রক্ত ঝরিয়েছে বলে নিজের পুরস্কারটি মেলিয়াজার ভালোবেসে আটালান্টাকে দিল। এতে মেলিয়াজার- এর দুই মাতুলসহ পুরুষ শিকারীরা প্রচন্ড ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল। মেলিয়াজার- এর দুই মাতুল আটালান্টাকে রূঢ়ভাবে আঘাত করে। মেলিয়াজার তাদের হত্যা করে। ভাইয়ের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে মেলিয়াজার- এর মা মেলিয়াজার কে হত্যা করে!
দেবী আর্টেমিস এভাবে প্রতিশোধ নিলেন!

... গ্রিক পুরাণের অকস্মাৎ ভায়োলেন্ট বাঁক বদল আমাদের বিস্মিত করে। নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ার থেকে আরম্ভ করে হালের হলিউডি মুভির কাহিনীর যে sudden twist আমাদের আকৃষ্ট করে তার অন্যতম কারণ কি গ্রিক মিথ? মাঝেমাঝে আমার মনে হয় গ্রিক মিথই যেন ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে পৃথক করেছে!




দেবী আর্টেমিস। গ্রিক পুরাণের আটালান্টা উপাখ্যানে বারবার ফিরে আসতে দেখি।

আর্কেডিয়া রাজ্যের রাজা আইয়াসুস তার বিখ্যাত কন্যাকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। অথচ একদিন তিনিই বলেছিলেন, যাঃ, ওটাকে আর্কেডিয়ার অরণ্যপ্রান্তরে ফেলে আয়। ওটাকে নেকড়েরা খেয়ে ফেলুক! যা হোক। আটালান্টা আর্কেডিয়ার রাজবাড়িতে ফিরে এল। মাবাবার সান্নিধ্যে দিন কাটতে লাগল তার। এবার ঘটল এক বিচিত্র ঘটনা। রাজা আইয়াসুস মেয়ের বিবাহ দেবেন। ওদিকে আজীবন কুমারী থাকবার ব্রত ছিল আটালান্টার। কিন্তু রাজা আইয়াসুস তার সিদ্ধান্তে অনঢ়। পরে অবশ্য আটালান্টা বিয়ে করতে রাজি হল। তবে দুটো শর্ত আছে।
কি শর্ত?
যে আমাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় পরাজিত করতে পারবে তাকেই আমি বিয়ে করব।
বেশ। আর?
দৌড় প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে ।
ঠিক আছে।
গ্রিসের অনেক বীর দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এল।
সবাই তারা হেরে গেল।
সেই সঙ্গে জীবন দিল।



হিপপোমেনেস এবং আটালান্টার দৌড় প্রতিযোগিতা

তখনকার দিনে হিপপোমেনেস নামে গ্রিসে এক সাহসী বীর ছিল। সে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বিষয়ে দেবী আর্টেমিসের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। দেবী আর্টেমিস হিপপোমেনেস কে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। দেবী আর্টেমিস হিপপোমেনেস কে তিনটি সোনালী আপেল দিলেন। তারপর বললেন, দৌড়ানোর সময় তুমি পথের ওপর একটা একটা করে আপেল ছুড়ে ফেলবে। পথে সোনালী আপেল দেখে আটালান্টা না থেমে পারবে না। সেই ফাঁকে তুমি দৌড়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে।
আপনি যা বললেন, আমি তাইই করব। বলল হিপপোমেনেস।
প্রতিযোগিতার শুরুতে আটালান্টা হিপপোমেনেস কে তেমন পাত্তা দেয়নি। যা হোক। দৌড় শুরু হল। হিপপোমেনেস একটা একটা করে আপেল ছুড়ে মারল ; পথে সোনালী আপেল দেখে আটালান্টা না থেমে পারল না।
সমাপ্ত রেখায় পৌঁছানোর পূর্বে শেষ আপেল ছুড়ে মারল হিপপোমেনেস।
সেটিও কুড়িয়ে নিতে আটালান্টার দেরি হয়ে গেল।
দৌড় প্রতিযোগিতায় হিপপোমেনেস বিজয়ী হল।
হিপপোমেনেস এবং আটালান্টার বিয়ে হল।



আটালান্টা; শিল্পীর তুলিতে

বিয়ের পর হিপপোমেনেস এবং আটালান্টার জীবন সুখে কাটতে লাগল । তবে সত্যিকারের সুখ বলতে যা বোঝায় আটালান্টার ক্ষেত্রে
তেমনটি কিন্ত হল না। কেন? বলছি। হিপপোমেনেস যত বড় বীর হোক- তার স্মরণশক্তি দূর্বল ছিল। সে দেবী আর্টেমিস-এর অবদান বেমালুম ভুলে গেল। দেবী ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। তিনি প্রতিশোধ নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। হিপপোমেনেস এবং আটালান্টা যখন দেবতা জিউস এর উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছিল ... Artemis inflamed the couple with such sexual passion that they led them to make love inside the temple. This was, of course, sacrilege (অধর্মাচরণ). Zeus, in his turn, got enraged and transformed them into lions. তৎকালীন বিশ্বাস অনুযায়ী সিংহ কেবলি চিতাবাঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। কাজেই বাকি জীবন হিপপোমেনেস এবং আটালান্টা পৃথকই রইল!

... আসলে ইউরোপের উন্নত শিক্ষাসংস্কৃতির মূলে গ্রিক মিথের গভীর অবদান রয়েছে। কেননা, গ্রিক উপকথার কেন্দ্রে রয়েছে মানবীয় প্রবৃত্তি। মধ্যযুগের একপেশে ও সংকীর্ণ খ্রিষ্টীয় শিক্ষার দাপটে ইউরোপ সুমহান গ্রিসিয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় রেঁনেসা আবার গ্রিসিয় ধ্রুপদি ঐতিহ্য কে ফিরিয়ে এনেছিল। যা হোক। গ্রিক মিথ আজও ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য এবং চলচ্চিত্রে গভীর প্রভাব রেখে চলেছে। আজ থেকে ২৫০০ বছর আগেই গ্রিক মিথরচয়িতারা কল্পনার বলগা হরিণ ছুটিয়ে মানুষের অবাধ কল্পনার দ্বারটি খুলে দিয়েছিল। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন